উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি : অন্ধাকারাচ্ছন্ন জনপদে আলো ছড়ানো এক গণপাঠাগার
৯ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ একটি নানন্দিক গণপাঠাগার
"অন্ধকারে আলোর প্রদীপ" শ্লোগান ধারণ করে ২০১০ সালে যাত্রা শুরু পাঠাগারের
প্রতিদিন পাঠকের পাদচারণায় মুখরিত থাকে পাঠকক্ষ।
অন্ধকার ছেদ করে আলোর দ্যোতি ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত
একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি
দূর হোক অন্ধকার, ছড়িয়ে পড়ুক আলো
কেটে যাক অমানিশা, খুলুক আলোর দ্বার, জ্ঞানের আলোয় প্রদীপ্ত হোক-লক্ষকোটি প্রাণ

আমাদের অর্জন

আমাদের গুণীজন

এক অজপাড়া গা থেকে আমাদের যাত্রা

এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদ। রক্ষণশীলতা এবং গোঁড়ামীর শিকড় যেখানে মাকসড়ার জালের মতো অবদ্ধ, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মুক্ত চর্চা যেখানে আকাশকুসুম কল্পনা, মানুষের মানসিকতা যেখানে পশ্চাতে আবদ্ধ। সে রকম এক অজপাড়া গাঁ থেকে যাত্রা হয়েছিল আমাদের। চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের খুদুকখালী গ্রাম। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই গ্রাম থেকে ১৫ বছর পূর্বে ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল চারটি চেয়ার, একটি টেবিল, একটি বুকসেলফ আর মাত্র ২০টি বই নিয়ে উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরির যাত্রা। চট্টগ্রাম শহর থেকে এ জনপদের দূরত্ব সাড়ে ৬৩ কিলোমিটার। এই গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠার প্রায় ২০ বছর পূর্বে যেটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে স্মরণকালের ভয়াবহ প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় পুরো জনপদ। ঘূর্ণিঝড়ের ২০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও গ্রামের মানুষ যেখানে বেচে থাকার জীবন-যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছিলেন- ঠিক সেই সময়ে ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল উপকূলবাসীর ভয়াল স্মরণীয় এই দিনে ‘অন্ধকারে আলোর প্রদীপ’ শ্লোগান ধারণ করে যাত্রা শুরু হয় এই গণপাঠাগারের। উদ্দেশ্য : অন্ধকারে আলো ছড়ানো, জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্ধকারকে বিতাড়ন। পড়ার প্রতি সবাইকে আহ্বান জানানো এবং গোঁড়ামীর শিকড় ভেঙে দিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় এ জনপদের মানুষকে মনোযোগী করে তোলা এবং তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদেরকে বইয়ের সান্নিধ্যে এনে পাঠমুখী করা। আমরা ছুটে চলছি আমাদের লক্ষ্য অর্জনে। বিগত ১৫ বছর ধরে ক্লান্তহীন পথচলা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে নিয়েছে অনেকদূর।

ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে ৩ বার

প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঠাগারটি এ পর্যন্ত তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৪ সালে এক টর্নেডোর আঘাতে পাঠাগারটি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানুর’ আঘাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাঠাগারটি। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’র আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয় যায় সবকিছু। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে পাঠাগারের পুরো চালা উড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায় প্রায় ২ হাজার বই। অনেকগুলো আসবাবপত্র ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া পাঠাগারটি পুনরায় সংস্কার করে পাঠ উপযোগী করে তোলা হয়।

উপহার

অন্ধকারে আলোর প্রদীপ

আমরা বিশ্বাস করি অন্ধকার দূর করতে হলে আলোর প্রয়োজন। যুগের পর যুগ যে জনপদটি অন্ধকারে ডুবন্ত, গোঁড়ামী আর রক্ষণশীলতায় আবদ্ধ, সেখানে আলো ছড়াতে হলে প্রদীপ লাগবেই। এখানে জ্ঞানের প্রদীপ-ই একমাত্র অন্ধকার ছেদ করে আলোর দ্যােতি ছড়াতে পারে। উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি হলো সেই জ্ঞানের প্রদীপ, জ্ঞানের বাতিঘর। আমরা স্থির করেছিলাম, আলো ছড়িয়ে দেব-অন্ধকার বিতাড়িত করব। যাত্রার শুরুতে আমরা একটি শ্লোগান নির্ধারণ করেছিলাম “অন্ধকারে আলোর প্রদীপ” আমরা সত্যিকার অর্থে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। আমরা হাজারো তরুণ ও শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পেরেছি, তাদেরকে পড়ার প্রতি মনোযোগী করে তুলতে পেরেছি, যে জনপদের শিক্ষার্থীরা জীবনে পাঠ্যবই ছাড়া ভিন্ন কোনো বইয়ের দেখা পায়নি, সেখানে আমরা শতশত তরুণ-তরুণীর হাতে বই তুলে দিয়েছি, পাঠের প্রতি, পাঠাগারের প্রতি মনোযোগী করে তুলেছি। একটি শ্লোগানকে ধারণ করে ১৫ বছর আগে ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা করা গণপাঠাগারকে ৯ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ এক গণপাঠাগারে রূপান্তরিত করেছি। বিগত একযুগে পাঠাগারের আশপাশ সংলগ্ন ৪টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিতে পেরিছ, বইমুখী হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণী । সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে পাঠ কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছি দেশব্যাপী। আমাদের ভাবনা শুধু একটি জনপদে সীমাবদ্ধ নয়, নয় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষে; আমাদের পথচলা সব মানুষের কল্যাণে, অন্ধকারের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামের, গোঁড়ামী দূর করে একটি মুক্ত ইতিহাস রচনার । এই পথচলা সীমাবদ্ধ নয় কোনো একটি সীমারেখায় ,জ্ঞানের বিশাল রাজ্যে নিজেদের সমৃদ্ধি অর্জনের জন্যই আমাদের বিরামহীন পথচলা ।

মুক্তমত

দরকার একটি টেকসই ভবন

বর্তমানে পাঠাগারটির অবকাঠামো খুবই দুর্বল। প্রতিবছর বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পাঠাগারটি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সর্বশেষ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় হামুন’র তাণ্ডবে পাঠাগারটি লণ্ডভণ্ড- হয়ে যায়, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের ফলে প্রায় ১ মাস খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে বই ও আসবাবপত্র। পাঠাগারের বর্তমান অবকাঠামো অনেকটা দুর্বল। কিন্তু পাঠাগারের সংগ্রহে থাকা হাজারো দুর্লভ বই, গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী, আসবাবপত্র ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য আমাদের শক্তিশালী কোনো অবকাঠামো নাই। সাগরে যখন ঘূর্ণিঝড়ের সূত্রপাত হয়, তখন আমাদেরকে ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হয়। আমরা ঘূর্ণিঝড়ে এতগুলো বই আর আসবাবপত্র কোথাও সরিয়ে নিতে পারিনা। যেহেতু এটি একটি দুর্যোগ ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা বছরের প্রায় সময় এখানে ঘূর্ণিঝড় আঘাতে হানে, আমাদের পাঠাগারের নিরাপত্তাবলয়ের জন্য একটি টেকসই ভবন দরকার। উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি সর্বসাধারণের জন্য একটি জ্ঞানের বাতিঘর। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ,পাঠাগারের জন্য একটি স্থায়ী ভবনের স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

পাঠকের লেখা