মানবজীবনে গ্রন্থাগার এক আলোকদিশা

মরিয়ম চোখে অন্ধকার দেখছে। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। অভাবের সংসারে ছোট্ট মেধাবী মরিয়ম কিভাবে তার জ্ঞানবৃদ্ধি করবে? কি উপায়ে সে তার জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে? এক অজ পাড়াগায়ে ছোট্ট মরিয়মের জন্ম । কৃষক বাবার অভাবের সংসারে মেধাবী মেয়েটা যেন গোবরে পদ্মফুল। মেধাবী হবার কারণে শিক্ষকদের সহযোগিতায় কি কষ্ট করেই না সে তার পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার তৃষিত হৃদয় জ্ঞানসাগরে ভেসে বেড়াতে চায়। অভাবী সংসারে বই কিনে পাঠ করার কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে গ্রামে যেসকল পাঠাগার গড়ে উঠেছে , মরিয়মের মতো যারা জ্ঞানপিপাসু অথচ কিনে বই পড়ার সামর্থ নেই তাদের জন্য গ্রাম্য গ্রন্থাগার গুলো এক অনন্য আলোক দুয়ার খুলে দিয়েছে। স্কুলের পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি এই পাঠাগার থেকে মরিয়মের মতো শিক্ষার্থীরা প্রচুর জ্ঞান আরোহনের সুযোগ পাচ্ছে।
সমদ্ধ পাঠাগার সব ধরনের পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করে; মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনে অবদান রাখে। বই ছাড়া প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না। তাই পাঠাগারের মাধ্যমেই একটি জাতি উন্নত, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে। জাতীয় জীবনে তাই পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা, অসীম কৌতুহল, অন্তহীন জ্ঞান ধরে রাখে বই। আর বই সংগৃহীত থাকে পাঠাগারে। পাঠাগার হলো সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদির এক বিশাল সংগ্রহশালা। পাঠাগারের বইয়ের ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়ে আছে মানবসভ্যতার শত শত বছরের ইতিহাসের হৃদয়স্পন্দন।
পাঠাগার কী তা নিয়ে যদি পর্যালাচনা করি তাহলে বলতে হয়, পাঠাগার বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন একটি বাড়ি বা ঘর, যেখা বই সংগ্রহ ও সংরক্ষিত থাকে। পাঠাগারের শাব্দিক প্রতিশব্দ হচ্ছে পুস্তকাগার, গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। পাঠাগারের মধ্যে  মানুষের হৃদয়ের উত্থান-পতনের ধ্বনি শোনা যায়। পাঠক এখানে স্পর্শ পায় সভ্যতার এক শাশ্বত ধারার, অনুভব করে মহাসমুদ্রের শত শত বছরের কল্লোল ধ্বনি, শুনতে পায় জগতের এক মহা ঐকতানের সুর। তাই পাঠাগার বা লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন।
এখন আমরা পাঠাগারের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো। পাঠাগারের ইতিহাস বেশ পুরনো। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের অনেককাল আগে থেকেই পাঠাগারের প্রচলন ছিল। তখন মানুষ তার জ্ঞান সঞ্চিত করে রাখত পাথর, পোড়া মাটি, পাহাড়ের গা, প্যাপিরাস, ভূর্জপত্র বা চামড়ায়। আর এগুলো সংরক্ষণ করা হতো লেখকের নিজের বাড়িতে, মন্দির উপাসনালয়ে এবং রাজকীয় ভবনে। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরে পাঠাগারের অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন গ্রিসেও পাঠাগার ছিল বলে প্রমাণ রয়েছে। ভারতে প্রাচীনকালে পণ্ডিতদের ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ বিহারসহ বিভিন্ন উপাসনালয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিক্রমশীলায় সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে ওঠে। এছাড়া আসিরিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া, বাগদাদ, দামেস্ক, চীন, তিব্বতসহ বহুস্থানে পৃথিবী-বিখ্যাত পাঠাগারের সন্ধান পাওয়া যায়।
আধুনিক কালে বিজ্ঞানের সহায়তায় উন্নত পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত পাঠাগারের মধ্যে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি, ফ্রান্সের বিবৃলিওথি নাৎসিওনাল লাইব্রেরি, ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। এই লাইব্রেরির সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শতাধিক পাঠাগার পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া ঢাকায় বাংলা একাডেমী গ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি, রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম, খুলনার উমেশচন্দ্র সৃতি গ্রন্থাগার সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার স্থাপন করে মানুষের জ্ঞানপিপাসা চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা আরও বেগবান হয়েছে। ঢাকা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের প্রচলন করে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বে নানা রকম পাঠাগার রয়েছে। তার মধ্যে ব্যক্তিগত পাঠাগার, পারিবারিক পাঠাগার, সাধারণ পাঠাগার, জাতীয় পাঠাগার উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পাঠাগারের পরিসর সীমিত। সাধারণ পাঠাগার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, তাই এর পরিসর অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের প্রয়োজনে যে পাঠাগার গড়ে ওঠে সেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক পাঠাগার। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবেও পাঠাগার স্থাপন করা হয়ে থাকে। সেগুলোকে জাতীয় পাঠাগার বলা হয়।
পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করলে বলা যায়, মানুষের শরীরের জন্য যেমন খাদ্যের দরকার, তেমনি মনের খাদ্যও তার প্রয়োজন। এই প্রয়োজন মেটাতে পারে পাঠাগার। পাঠাগার মানুষের ক্লান্ত, বুভুক্ষু মনকে আনন্দ দেয, জ্ঞান প্রসারে জাগ্রত করে। পাঠাগারে সংগৃহীত থাকে নানা মত ও পথের বই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় : -“লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোন পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোন পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোন পথ মানব হৃদয়ের অতল স্পর্শ করিয়াছে। যে যেদিকে ইচ্ছা ধাবমান হও কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে।”
সমদ্ধ পাঠাগার সব ধরনের পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করে; মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনে অবদান রাখে। বই ছাড়া প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না। তাই পাঠাগারের মাধ্যমেই একটি জাতি উন্নত, শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে। জাতীয় জীবনে তাই পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ :- “গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি যা দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে রাখে অমূল্য অবদান।”
বই পড়ার যে আনন্দ মানুষের মনে, তাকে জাগ্রত করে তুলতে আজ সব ধরনের পাঠাগারের ব্যাপক প্রসার প্রয়োজন।
পাঠাগার মানবসভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিক ইতিহাস, মানব-হৃদয়ের মিলনক্ষেত্র। সুস্থ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে পাঠাগার একান্ত অপরিহার্য। স্কুল-কলেজের উপরে পাঠাগারের স্থান। জাতির প্রকৃত জ্ঞানার্জন ও প্রাণশক্তি বৃদ্ধির জন্য স্কুল-কলেজের মতো দেশের সবখানে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক: মাহবুবা সুলতানা শিউলি, কলামিস্ট