রেশমিনা
অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দিতে আমাদের লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। একটি ক্ষুদ্র পরিসর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমাদের যাত্রা ক্ষুদ্র পরিসর থেকে হলেও আশা ছিল অনেক বড়। স্বপ্ন বুনে ছিলাম বিশাল হৃদয় দিয়ে । আমাদের আশা আর স্বপ্নজুড়ে ছিল অন্ধকারে আলো ছড়ানো। সে আশা ধারণ করে এক অজপাড়া গায়ের জরাজীর্ণ একটি সাইক্লোন শেল্টার থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল উপকূলের বাতিঘর খ্যাত দেশের প্রান্তিক জনপদের অন্যতম বৃহত্তম গণপাঠাগার উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরির।
চিন্তাশীল লেখক, গবেষক ও অনুবাদক সাতির মাহদী আমাদের পাঠাগারের জন্য একটি শ্লোগান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ‘অন্ধকারে আলোর প্রদীপ ’ তিনি বলেছিলেন একদিন উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী অন্ধকার জনপদে আলো ছড়াবে। অন্ধকারকে বিতাড়িত করে এই জনপদের মানুষকে আলো দেখাবে। তিনি যখন শ্লোগানটি ঠিক করেছিলেন।, তখনো আমাদের ধারণায় আসেনি যে, অন্ধকারে আলো জ্বালাতে গেলে কিভাবে আগুনের শিখায় নিজেদেরকে মোমের মতো গলিয়ে যেতে হবে এবং কত বড়ো বড়ো বাধা অতিক্রম করতে হবে!
আমরা যখন পুরোদমে আলো ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যাশা নিয়ে কাজ শুরু করলাম, তখন থেকে আমরা চতুর্মুখী বাধার সম্মুখীন হতে লাগলাম। এ যেনো আমাদের এক অস্তিত্বের লড়াই! আমরা নিজেরা জাগ্রত হতে গিয়ে যেনো ঘুমন্ত কোন জনপদকে জাগিয়ে দিলাম। কারণ শত বছর ধরে অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত একটি জনপদে যখন আলোর শিখা জ্বলে উঠলো, তখনই শুরু হলো আলো আর আঁধারের আসল লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের মূল জায়গাটা হলো উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী। আমরা সেই ২০১০ সাল থেকে ক্লান্তহীন লড়াই চালিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি।
উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরীর অবস্থান যেখানে, সেটি আমাদের জন্মস্থান। আমাদের নাভির শিখর। আমাদের মূল পরিচয়ের স্বাধীন ভুমি। আমাদের শৈশবের দুরন্তপনার প্রিয় জন্মভূমি। কিন্তু আমাদের জন্মস্থানে যখন পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু করলাম, তখন থেকে আমরা পরাধীনতার কালো চাদরে ঢাকা পড়তে লাগলাম। এখানকার কালো চাদরে ঢাকা মানুষগুলোর কথা হলো, অন্ধের দেশে আপনারা কেন আয়না বিক্রি করতে আসলেন? এটি কখনো মেনে নেয়া হবে না। এখানে আলো জ্বালানো এত সহজ না।
কিন্তু কোনো কালো চক্ষু আমাদেরকে দাবায়ে রাখতে পারেনি। আমরা চক্ষুশীলদের কালো চাহনিকে মোটেও ভয় পাইনি। জ্ঞানের আলোর শিখা আমাদেরকে সাহসী হতে অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদেরকে বীরের বেশে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা একটি যুদ্ধক্ষেত্র আবিষ্কার করেছি। যেটির মাধ্যমে আমরা চলার পথে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। এটি আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছে, সাহস যোগাচ্ছে।
অন্ধকারে নিমজ্জিত রাঘববোয়ালরা কখনো চায়নি, এখানে আলো জ্বলে উঠুক। আলোর প্রদীপ ছড়িয়ে পড়ুক। ১৫ বছর আগের সেই সূচনার কথা মনে পড়লে এখন বলতে হয় স্বাধীনতার পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমরা ঘুমের মধ্যে ছিলাম। আমাদেরকে অন্ধকার জনপদে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছিল। কেউ একটু জাগ্রত হতে চাইলে তাকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে নাস্তানাবুদ করে দেয়া হয়েছে। কেউ চাইলেও সহসা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস করতো না।আমরা জাগিয়ে তুললাম
একটি জনপদে বছরের পর বছর ধরে ভীতি প্রদর্শন করে যে অন্ধকার রীতি সমানতালে চলে আসছিল, সেখানে আমরা বারুদের মতো আঘাত হেনেছি। বলতে গেলে অর্ধশত বছরের লালিত একটি শৃঙ্খলকে আলোর রশ্মি দিয়ে বিতাড়িত করেছি। আমরা এটাই চেয়েছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল, আমরা এখানে জ্ঞানের বাতি জ্বালাব। জ্ঞানের আলো দিয়ে অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দেব।সবার হাতে বই
খুদুকখালীর মতো প্রত্যন্ত জনপদের প্রায় শিশু, কিশোর,তরুণ তরুণীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়ার একটি কাঙ্কিত সফলতা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। আমরা তাদেরকে বইয়ের সানিধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছি। এখানে আমাদের পাঠাগার আন্দোলনের বড় স্বার্থকতা। এ কথাটি স্বীকার করতে হবে যে, যদি উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী এখানে যাত্রা শুরু না করতো, তাহলে আজকে আলোর সারথিতে আসা ছেলে মেয়েরা বরাবরের মতো বই বিমুখ থাকতো, তাদের হাতের নাগালে আসতো না হাজারো বইয়ের সমাহার।চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে বই আড্ডায়
গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুল মাদরাসার ছুটি শেষে গ্রামের চায়ের দোকানে বসে টিভি দেখে কিংবা গল্প করে সময় পার করে। স্কুল ছুটি শেষে ব্যাগটা রেখে এক দৌড়ে চায়ের দোকানের আড্ডায় বসে পড়াটা ছিল রীতিনীতি। আমরা সেই অন্ধকার রীতি থেকে তরুণদেরকে ফিরিয়ে এনেছি। তাদেরকে চায়ের দোকানের নস্টালজিয়া থেকে পাঠাগারের আলোর টেবিলে নিয়ে এসেছি।
রেশমিনা, উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরির একজন নিয়মিত পাঠক সদস্য