অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন তৈরির অন্যতম মাধ্যম হলো পাঠাগার। এর বিকল্প পৃথিবীতে আজও সৃষ্টি হয়নি।মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই পাঠাগােরর উৎপত্তি। পাঠাগার একটি জাতির বিকাশ ও উন্নতির মানদণ্ড। পাঠাগার মানুষের বয়স, রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী বই সরবরাহ করে থাকে। গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি, যা দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে অমূল্য অবদান রাখে। শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে মানুষের সব জ্ঞানের সংগ্রহ জমা রয়েছে বইয়ের ভেতরে। অন্তহীন জ্ঞানের উৎস হলো বই, আর সেই বইয়ের আবাসস্থল হলো পাঠাগার। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা ও বাস্তবতা বইয়ের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়ে আসছে। তাই প্রতিটি মানুষের জীবনে পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

আমরা এই বিষয়ে একমত যে, শুধু পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নে জীবেন সমৃদ্ধি আসবেনা। এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পাবে না। পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে বহির্জগতের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করতে হবে।

আমরা উপলদ্ধি করতে পেরেছি যে, চিন্তাশীল মানুষের কাছে পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পাঠাগারের উপযোগিতা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ মৌলিক চাহিদা মেটাতেই আমরা হিমশিম খাই। আমাদের পক্ষে সব বই কিনে পড়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। কম লেখাপড়া জানা ও গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পাঠাগার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও পাঠাগারের ভূমিকা অতুলনীয়। একটি সমাজের রূপরেখা বদলে দিতে পারে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। আজকের তরুণরাই আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। তাদের মানসিক বিকাশের মাধ্যমে সমগ্র জাতির উন্নতি সম্ভব। তাদের বিকাশ সাধনের জন্য শহরের পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামে-মহল্লায় পাঠাগার গড়ে তোলা সময়ের দাবী।

আমরা বাস্তবতার আলোকে অনুধাবন করতে পেরেছি যে, আমাদের নিজেদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আমরা আদর্শ মানুষ হয়ে উঠতে পারি। কারণ আদর্শ মানুষই দেশের প্রকৃত সম্পদ। নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে জ্ঞান চর্চার বিকল্প নাই। জ্ঞানিভিত্তক গড়ে তোলার বিকল্প নাই। জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজ ব্যবস্থা অন্ধকার দূর করে আলোর দ্যোতি ছড়াতে পারে।

আমাদের ভাবনা, উপলদ্ধি, অনুধাবন এবং চিন্তা-শক্তির একটি দায়িত্ববোধ থেকে ‘অন্ধকারে আলোর প্রদীপ’ শ্লোগান ধারণ করে ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলার বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এক উপকূলীয় জনপদে চারটি চেয়ার ,দুটি টেবিল এবং ১০ টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু হয় উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরির।

আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

(১) একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সবার মাঝে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার প্রতি জনপদের মানুষকে আহ্বান জানানো; যাতে তারা একটি সুস্থ ধারার সুন্দর বিকশিত জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।

(২) শিক্ষা, সাহিত্য, গবেষণায় সার্বিক উন্নতি সাধনের জন্য আগামীর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এতদুদ্দেশ্যে একটি শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রশিক্ষণ, গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা

(৩) পাঠাগারের সকল সদস্যদেরকে জাতীয়, সামাজিক, ব্যক্তিগত, নৈতিক ও পেশাগত উন্নয়নে তাদের যথার্থ দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করা।

(৪) পাঠাগারের সদস্যদের মাঝে সহযোগিতা, সংহতি ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি করা, পেশার মান ও মর্যাদা সমুন্নত করা এবং সদস্যদের আচার-আচরণ এবং জাতীয় জীবনের সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।

(৫) আলোচনাসভা, বক্তৃতামালা, সম্মেলন, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ আয়োজন; সাময়িকী, জার্নাল ও বই-পুস্তুক প্রকাশনা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকান্ডের মাধ্যমে লাইব্রেরীর সদস্যদেরকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতা অর্জনে সাহায্য ও উৎসাহ প্রদান করা।

(৬) আজীবন শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য সবার মাঝে বইপাঠ এবংপাঠাগারের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং একটি ধারণা জাগিয়ে দেওয়া। শিক্ষার্থীদের আজীবন শেখার দক্ষতার সাথে সজ্জিত করার জন্য তাদের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, কল্পনা বিকাশ এবং তাদেরকে আদর্শ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে কর্মসূচী গ্রহণ করা।

(৭) পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বহুমুখী জ্ঞানার্জনে অনুপ্রাণিত করতে এবং হাজারো বইয়ের সাথে একটি সাঁকো তৈরি করে দিতে পাঠাগারে বই পড়তে আগ্রহী করে তোলা, শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি ভাঙতে এবং তাদেরকে মুক্ত চর্চায় ফিরে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, নতুন নতুন জিনিস শেখার প্রতি অনুপ্রাণিত করা, শিক্ষার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা এবং তাদের জীবনের উন্নতি সাধনে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্দর পরামর্শ প্রদান করা।

(৮) শিশুদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, শিশুকাল থেকে বইয়ের সাথে সাঁকো তৈরি করে দেওয়া এবং শেখার পরিপূরক উপকরণ প্রদান করা

(৯) এই গ্রন্থাগারের পাঠাগারের মূল লক্ষ্য : তথ্যসংশ্লিষ্ট উপাদান সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সংগঠন, সমন্বয় এবং পাঠকের জন্য তা উন্মুক্ত করা।

(১০) সকল পাঠকদের জন্য তথ্যের চাহিদাকে সমর্থন করে বই, জার্নাল, ডাটাবেস, মাল্টিমিডিয়া উপকরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা এবং এগুলোর মাধ্যমে গবেষণা, অধ্যাবসায়, শিখন, চর্চা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধির সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

(১১) এই পাঠাগারের মাধ্যমে সব বয়সী মানুষকে শিক্ষামূলক উন্মুক্ত পাঠ সেবা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো। শিশুদের জন্য সাক্ষরতা প্রোগ্রাম, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য শিক্ষামূলক কর্মশালার ব্যবস্থা করা। এর মূল উদ্দেশ্য: জনপদের সকল নাগরিককে পড়ার প্রতি মনোযোগী করে তোলা এবং তাদের জ্ঞান চর্চার জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

(১২) এই পাঠাগারের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে ভূমিকা উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিশেষ করে দুর্লভ বই, পান্ডলিপি, আর্কাইভ এবং অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষণ করা যা আমাদের সমাজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলে।

(১৩) সমৃদ্ধ জাতি গঠনে গ্রন্থাগারের প্রয়োজন যে অপরিহার্য তা পৃথিবীর সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিসমূহের ইতিহাস পাঠে জানা যায়। গ্রন্থাগার জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার এক অনন্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তেমনিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার শুধু অপরিহার্য নয় বরং প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধির একটি পরিমাপক হচ্ছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।

(১৪) এই পাঠাগার হবে একাধারে পাঠকেন্দ্র, গ্রন্থ সংগ্রহশালা, অনুবাদকেন্দ্র, গবেষণাকেন্দ্র, বিজ্ঞান গবেষণাগার এবং একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, এখানে জ্ঞানভিত্তিক নানা কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হবে। গ্রন্থাগারে আগত পাঠক, গবেষক ও অন্যান্য ব্যবহারকারীরা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। সেই সাথে পাঠাগারে গবেষণার একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা এবং পাঠকদের বৃত্তি প্রদান ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। সকল পাঠকের কাছে বই এবং পাঠাগারকে মানবতার জাগতিক উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে উপস্থাপন করা।

এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরির পথচলা। আমাদের এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে যারা একমত পোষণ করেন, তাঁদেরকে আমাদের কমিউনিটিতে আমন্ত্রণ জানাই, তাঁদের সাথে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে একসাথে চলতে চাই এবং একটি সমৃদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে কার্যকর ভুমিকা রাখতে চাই।