ছাত্র জীবনে প্রায় ১০/১২ বছর বাংলা ভাষার ব্যাকরণ পাঠ করার পরও আমরা শুদ্ধ। ভাষায় বাংলা লিখতে পারিনা। বিশেষ করে বাংলা শব্দের বানান প্রয়োগ করতে গিয়ে আমরা প্রায় সময় বানান ভুল লিখে থাকি। এভুলটা শুধু সাধারণ মানুষরা করে না। সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতের বড় বড় কর্তারাও করে থাকেন। পৃথিবীর অন্যকোন দেশে সচরাচর মাতৃভাষার প্রতি এমন অবজ্ঞা দেখা যায় না। প্রশ্ন হলো, ১০-১২ বছর বাংলা ব্যাকরণ পাঠ করার পরও কেন আমরা মাতৃভাষার ভুল লিখি? মাতৃভাষা চর্চায় কেন আমরা অবজ্ঞা করি।
বাংলা ভাষার বানান কি তাহলে খুব কঠিন! না কি এ ভাষার শিখনের পাঠকে আমরা মুখস্থ সংজ্ঞার পাঠ শিখাতে শিখাতে একটি গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে গেছি? বাস্তবতা হলো, বাংলা মাতৃভাষার বানান চর্চা কঠিন কোনো পাঠ নয়। এখানে পার্থক্য হলো, ব্যাকরণ পাঠের সংজ্ঞা মুখস্থ করণ আর বানানের প্র্যাকটিক্যাল সহজ চর্চার মধ্যে। বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চার জন্য অনেকগুলো বানানরীতি চর্চার বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকেও বানান বিধির বই প্রকাশিত হয়েছে।
অভিজ্ঞতার বাস্তবতা হলো, শুদ্ধ বানান চর্চার জন্য প্রণীত বানানরীতির বইগুলোর উপস্থাপনা যত সহজ এবং সহতরভাবে বোঝা যায়, সেটা কিন্তু ব্যাকরণের ভাষায় একটু কঠিন।
যেমন বানান চর্চার বই ‘ প্রমিত বাংলার সহজপাঠ’ বইয়ে দুর এবং দূর শব্দের ব্যবহারের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে একেবারে সহজভাবে, বলা হয়েছে ” দুর দ্বারা দূরত্ব না বোঝালে দ উপসর্গে উ-কার হবে। যেমন: দুর্ঘটনা, দুর্যোগ, দুরন্ত ইত্যাদি, আর দূর দ্বারা দূরত্ব বোঝালে দূ উপসর্গে ঊ-কার হবে। যেমন: দূরত্ব, দূরবর্তী, অদূর ইত্যাদি।
এখানে পার্থক্য হলো, ব্যাকরণের ভাষায় এত সহজভাবে বানানের সহজ দিকগুলো উপস্থাপন করা হয়নি। যার কারণে ৮/৯ বছর বাংলা ব্যাকরণ পড়েও আমরা শুদ্ধ বানান লিখতে পারিনা। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষার প্রতি অনেক ক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মান, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তো প্রকাশ পায়ই না, কোনো কোনো সময় অবজ্ঞার ভাবই ফুটে ওঠে।
ছাত্র জীবনে ব্যাকরণ বইয়ের সাথে আলাদা একটি বানানরীতির বই পাঠ্য তালিকায় যুক্ত করা হলে ভুল বানান চর্চা এবং ভুল বানান লিখন অনেকটা কমে আসবে। একইসাথে শুদ্ধ বানান চর্চা বৃদ্ধি পাবে। প্রান্তিকের গণপাঠাগার উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি বানান চর্চার এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অনুধাবন করতে পেরেছে।
দেখা গেল, ২০০ শব্দের ছোট একটি লেখার মধ্যে প্রায় দশ থেকে বারোটা শব্দের বানান ভুল লিখছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু যখন তারা বানান ভুল লিখছে, ততোদিনে তারা পাঁচটি বছর ব্যাকরণের পাঠ নিয়েছে। তাহলে পাঁচ বছর ব্যাকরণ পাঠ নেয়ার পরও কেন তারা বানানে ভুল লিখছে? বিষয়টি আমাদের সবার ভাবনায় আনা উচিত। বাংলা একাডেমি, জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সহ সবাইকে শুদ্ধ বানান চর্চার জন্য করণীয় নির্ধারণ এবং সহজ এবং সাবলীল ভাষায় শিক্ষার্থীরা যেভাবে মাতৃভাষারর শতভাগ শুদ্ধ বানান লিখতে পারে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী।
আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথে অকাতরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেক ভাষা সৈনিক । মাতৃভাষাকে অটুট রাখার জন্য তারা সেদিন অকাতরে জীবন দিয়েছিলেন। মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য পৃথিবীর বুকে অন্যকোনো দেশ এবং জাতি বাঙালি জাতির মতো এভাবে অকাতরে আত্মাহুতি দেন নি।
কিন্তু আমরা যখন মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করি, ভাষা চর্চার প্রতি অনীহা প্রকাশ করি, একলাইন বানান লিখতে গিয়ে চার লাইন ভুল বানান লিখি, তখন সেটি ভাষা শহীদদের প্রতি সরাসরি অবজ্ঞা প্রদর্শনের নামান্তর।একইসাথে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এঅবস্থার জন্য কম দায়ী নন। তারাও দায় এড়াতে পারেন না। কারণ স্বাধীনতার ৫২ বছরের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পরও মাতৃভাষার ভুল ছড়াছড়ি রোধ করতে আদৌ কোন কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। একক কোনো বানানরীতি অনুস্মরণ করার কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারে নি।
একটি পর্যবেক্ষণ:
উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি ২০২২ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ” এসো বানান শিখি শুদ্ধ লিখি” এ শিরােনামে একটি বানান চর্চা ক্লাসের শুভসূচনা করে। ক্লাসটিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে উপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। বানানরীতির ক্লাসে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা এখান থেকে যা কিছু শিখছে, এগুলো যেনো তাদের জন্য নতুন। এর আগে তারা এগুলো সম্পর্কে কোন ধারণা পায় নি। এই ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও আছে। প্রশ্ন জাগে, বানান চর্চার এই পাঠ যদি তাদের কাছে নতুনের মতো হয়, তাহলে ব্যাকরণ পাঠ থেকে তারা কী শুদ্ধ বানান চর্চার পাঠ পায় নি? এই দিকটি আমাদেরকে ভাবনায় আনতে হবে।
ব্যাপক সাড়া:
সাম্প্রতিক সময়ে চালু হওয়া বানানরীতির ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সাড়া পেলেছে। যারা ক্লাসটিতে অংশগ্রহণ করে, তাদের আগ্রহ এবং মনোযোগ লক্ষ করার মতো। শুদ্ধ বানান চর্চার প্রতি তাদের আগ্রহ প্রচুর। এখানে এসে তারা শুদ্ধ আর অশুদ্ধ চেনার সুযোগ লাভ করছে।
ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র:
প্রান্তিকের গণপাঠাগার উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি থেকে চালু হওয়া ” এসো বানান শিখি শুদ্ধ লিখি” ক্লাসটি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। এরই ধারাবাহিকতায় ক্লাসটি কয়েকটি পাঠাগারে চালু হয়েছে এবং ক্লাস সমূহে আগ্রহীদের ব্যাপক সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপে ক্লাসটি চালু হয়েছে বাঁশখালী উপজেলার বাঁশখালা গ্রামের আলোর পাঠশালা বিদ্যাবাড়ি গণপাঠাগারে। পাঠাগারে বানানরীতির ক্লাসটিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
আমরা চাই, বানানরীতির ক্লাসটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক। চর্চা হোক শুদ্ধ বানান চর্চার। মাতৃভাষার প্রতি আসুক স্বকীয়তা। তাহলে ভাষার জন্য আত্মাহুতি দেয়া বাংলার দামাল সন্তানদের এই আত্মা শান্তি পাবে। তাদের আত্মাহুতি স্বার্থক হবে।