চট্টগ্রাম শহর থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বাঁশখালী উপজেলার এক গ্রাম খুদুকখালী। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে সেখানে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্মরণকালের ভয়াবহ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় গ্রামটি। বহু মানুষের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের ২০ বছর পর ২০১০ সালের ওই ২৯ এপ্রিলেই সেখানে ডানা মেলে নতুন স্বপ্ন। দুই দশক আগের সেই অন্ধকার রুখতেই যেন ওইদিন গ্রামের আঙিনায় স্থাপন করা হয় এক আলোর বাতিঘর। উদ্দেশ্য, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় মানুষকে মনোযোগী করে তোলা। শিক্ষার্থীদের বইয়ের সান্নিধ্যে এনে পঠনপাঠনের এক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। আলোর সেই বাতিঘরের নাম দেওয়া হয় ‘উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি’। প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ওই গ্রন্থাগার। আজ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে সময়ের আলোর পাঠকদের জন্য সেই ‘উপকূলের বাতিঘর’ নিয়ে প্রতিবেদন।
এক নজরে উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি : ১৪ বছর আগে চারটি চেয়ার, একটি টেবিল, একটি বুকসেলফ আর মাত্র ২০টি বই নিয়ে যাত্রা করা গণপাঠাগারটি আজ ৯ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ এক গণপাঠাগার। পাঠাগারের নামে ক্রয়কৃত ২২ শতক জমির ওপর নিজস্ব ভবনে চলছে পাঠ কার্যক্রম। যাত্রা শুরুর পর থেকে পাঠাগারের আশপাশ সংলগ্ন ৪টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়েছে, বইমুখী হয়েছে অনেক তরুণ-তরুণী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে পাঠ কার্যক্রমের পরিধির বিস্তার ঘটিয়েছে দেশব্যাপী। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক সাঈফী আনোয়ারুল আজীম পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন।
পাঠের বিস্তৃতি : উপকূলীয় ওই গ্রামে দৈনিক পত্রিকা পড়া ছিল দুরূহ ব্যাপার। একটি পাঠাগারের বদৌলতে এখন এলাকার শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে বইয়ের দেখা মেলে। শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় এসেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাময়িকী। গ্রামের সাত বছরের শিশুটিও এখন দৈনিক কয়েকটি পত্রিকা পড়তে পারে এখানে। প্রতিদিন পাঠাগারের আশপাশ-সংলগ্ন এলাকা থেকে পাঠকরা এসে পাঠাগারে বই পড়েন, পছন্দের বইটি ১৫ দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে যান। এই পাঠকদের সঙ্গে পাঠাগারের একটি সাঁকো তৈরি হয়েছে, গড়ে উঠেছে আত্মার বন্ধন। পাঠাগারের সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, এই পাঠাগার না হলে একসঙ্গে আমাদের এত বইয়ের সমাহার দেখার সুযোগ হতো না। পাঠাগার হওয়ার আগে আমরা এখানে পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়ার সুযোগ পাইনি।
আছে বিপুল সমাহার : বর্তমানে পাঠাগারে দর্শন, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ গন্থ, উপন্যাস, ছোটগল্প, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, ঐতিহ্য, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা-জ্ঞান, গবেষণা, অনুবাদ সাহিত্য, অর্থনীতি বিষয়ক ৯ হাজার বই রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও মনীষীদের গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের সংগ্রহও পাঠাগারে রয়েছে।
শক্তি জুগিয়েছে নারীরা : এই পাঠাগারে শুরু থেকেই ছিল নারী পাঠকদের আধিক্য। এর ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। প্রান্তিক জনপদের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভয়কে পেছনে ফেলে নারীরা পাঠাগারমুখী হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে নারী পাঠকরা পুরো লাইব্রেরি আঙিনাকে মুখরিত করে রেখেছে। তাদের পদচারণায় একটি পাঠকমুখী পাঠাগারে রূপ নেয় গ্রন্থাগারটি।
শুরুতেই যখন লাইব্রেরিতে নারী পাঠকরা আসা শুরু করেন, তখন তারা নানা কটূক্তির সম্মুখীন হন। তারা এগুলোকে মোকাবিলা করতে শেখেন, সাহসের ভূমিকা রেখে প্রতিবাদীর ভূমিকা রাখেন। পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক কলি আকতার জানান, কারও রক্তচক্ষু কিংবা কটূক্তিতে কোনো পাঠক যেন হতাশায় না ভোগেন, সেই বিষয়গুলো নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করে পাঠকের মনে লুকিয়ে থাকা ভয়গুলো ভেঙে দিয়েছি আমরা।
স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকার সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি এক হাজার গ্রন্থাগারে স্থাপন করে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার’। এরই ধারাবাহিকতায় প্রান্তিকের গণপাঠাগারটিতেও স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। এই কর্নারের মাধ্যমে উপকূল এলাকার হাজারো শিক্ষার্থী খুব সহজে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার সুযোগ লাভ করেছে।
দরকার একটি টেকসই ভবন : প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঠাগারটি এ পর্যন্ত তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৪ সালে এক টর্নেডোর আঘাতে পাঠাগারটি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানুর’ আঘাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবশেষ ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’র আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সবকিছু। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে পাঠাগারের পুরো চালা উড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায় প্রায় ২ হাজার বই। অনেক আসবাবপত্র ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, পাঠাগারের সংগ্রহে থাকা হাজারো দুর্লভ বই, গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী, আসবাবপত্র ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী কোনো অবকাঠামো নেই। তিনি জানান, সাগরে যখন ঘূর্ণিঝড়ের সূত্রপাত হয়, তখন তাদেরকে ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হয়। পাঠাগারের নিরাপত্তা বলয়ের জন্য একটি টেকসই ভবন তাই খুবই দরকার।

এম. বেলাল উদ্দিন
বাঁশখালী প্রতিনিধি, দৈনিক সময়ের আলো ও একুশে পত্রিকা
বাঁশখালী প্রতিনিধি, দৈনিক সময়ের আলো ও একুশে পত্রিকা
প্রকাশ: সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪